নতুন শিক্ষাক্রমের সুবিধা ও অসুবিধা ২০২৪ | নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে সমস্যা ২০২৪
নতুন শিক্ষাক্রম চলে আসছে আগের মতন আর নাকি কোন পরীক্ষা থাকবে না একাদশ শ্রেণির আগে আর সাইন্স আর্টস কমার্স এর মতন বিভাগ বিভাজন থাকবেনা। কি আছে এই শিক্ষাক্রম এর মধ্যে, ক্লাসে কি আসলেই শিক্ষকরা আর পড়াবেন না? শিক্ষার্থীরা কি বিজ্ঞান থেকে দূরে সরে যাবে? আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই নতুন শিক্ষাক্রম ও বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব এই পুরো ব্যাপারটি আজকে আলোচনা করবো (মন দিয়ে পড়বেন)।
চলুন শুরু করা যাক; শিক্ষাক্রমে এই নতুনভাবে ঢোকানো হয়েছে
- নাম্বার (১): এইখানে কেউ আপনাকে পড়াইয়া দিবে বা শিখিয়ে দিবে এই কনসেপ্টটা নাই, বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষার্থীরা নিজে নিজে জিনিসগুলা শিখবে।
- নাম্বার(২): কোন শ্রেণীর রোল থাকবেনা, প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান থাকবে না সবাই সমানভাবে বিবেচিত হবে।
- নম্বরটি(৩): এক জন শিক্ষক উনি হবেন একজন সহায়তাকারী। সরাসরি উনি একটা জিনিসকে শিক্ষা দিবেন না বরঞ্চ কি করে একটা জিনিস শিখতে হয় এই ব্যাপারটা নিয়ে ডিসকাস করবেন।
- নাম্বার(৪): (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ) মূল্যায়ন হবে কিভাবে; এতদিন তো পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হতো।
কিভাবে মূল্যায়ন হবে এখানে দুইটা ব্যবস্থা।
নাম্বার __১: শিখনকালীন মূল্যায়ন: আপনি যখন শিখেছেন কতটুকু শিখতেছেন, আগ্রহ আছে নাকি আপনার, ক্লাসে আপনি কেমন ব্যবহার করতেছেন, দলগত কাজবাজ গ্রুপ ওয়ার্ক এর মধ্যে আপনার পারফরম্যান্সটা কিরকম? এই ব্যাপারগুলা মূল্যায়ন করা হবে যা এটা বছরব্যাপী চলবে।
নাম্বার __২: সামষ্টিক মূল্যায়ন: একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে আমার স্টুডেন্ট কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করছে এই ব্যাপারটা এখানে মূল্যায়িত হবে। এইটা হবে বছরের ঠিক মধ্যভাগে ছয় মাস পরে যেটা সামষ্টিক মূল্যায়ন
(১) এখানে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জন মাত্রাটা যেটা আছে এটা যাচাইয়ের জন্য একটা অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন তৈরি করা হবে এন্ড এইটার ভিত্তিতে শিখন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, আরেকটা হবে শিক্ষা বছর শেষে যেটা সামষ্টিক মূল্যায়ন
(২) এই সামষ্টিক মূল্যায়ন গুলা হইতেছে আমাদের আগের পরীক্ষার একটা নামান্তর তবে দুইটার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নিজের মূল্যায়ন শিক্ষণকালীন হবে এখানে কোন পরীক্ষা নাই। ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত এখানে পাঁচটা বিষয় থাকবে, এই পাঁচটা বিষয়ের কিছু অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। (এই যে বলতেছিলাম গ্রুপ ওয়ার্কের মধ্যে কেমন করতেছে, কতটুকু শিখতেছে, আগ্রহ আছে নাকি এসব) আর বাকি অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে তারমানে পরীক্ষার ভিত্তিতে।
এইখানে অভিভাবকদের বেশকিছু দুশ্চিন্তার জায়গা আছে(অভিযোগ তুলেছে):
নাম্বার ওয়ান: পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থীরা পড়তেই চায়না, ওরা কিভাবে প্রস্তুতি নেবে? এই ধরনের নির্দেশনা সুনির্দিষ্টভাবে না থাকায় একটা ভচকর পাকাইছে তদের মধ্যে যেমন এখন ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়নটা হইতেছে আর বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন যেটা হবে অর্থাৎ বার্ষিক পরীক্ষা ধরতে পারেন ওইটা সময়সূচি প্রকাশ করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের।
এই ঘোষিত সূচি অনুযায়ী ৫ নভেম্বর থেকে এই মূল্যায়নটা শুরু হবে। অভিভাবকদের অভিযোগ হচ্ছে এখনো এই মূল্যায়নের নির্দেশ স্কুলে পাঠানো হয় নাই আগামী ২৯ অক্টোবর এই নির্দেশনা স্কুলে পাঠানো হবে তার মানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউ এখনো জানতেছে না যে কিভাবে বার্ষিক মূল্যায়ন হবে।
দুইনাম্বার অভিযোগ: শিক্ষকরা হয়তো মনগড়া মূল্যায়ন করতে
পারে। অভিযুক্ত হচ্ছে শিক্ষকদের উপর এখন বেশি চাপ পড়ে যাছে কি না? এতদিন একটা বিষয় একভাবে পড়ালেই হত পরীক্ষার খাতা চেক করলে আমার কাজ শেষ এখন কিন্তু ব্যাপারটা ওইটা না নতুনভাবে শিখাইতে হচ্ছে, পুরো বছরজুড়ে মূল্যায়নটা করতে হবে। একদম প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত তথা গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত যে শিক্ষকরা আছে ওদের ক্যাপাবিলিটি আছে কিনা এই ধরনের শিখন কালীন মূল্যায়ন করার কিংবা সারা বছর ধরে অ্যাসেসমেন্ট চালানোর এই ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করছেন অনেকেই। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা পেক্ষাপটে এইখানে এখন নাম্বার এর উপরে শিক্ষকদের পছন্দ-অপছন্দের প্রভাব কিন্তু পরতেই পারে। কোন শিক্ষার্থীদেরকে চাপে ফেলা নিজের কাছে প্রাইভেট পড়ানো কিংবা কোচিং করানোর পরে পরীক্ষার্থীদেরকে নম্বর দেওয়া হতে পারে যেহেতু মূল সুতাটা শিক্ষক।
তিন নাম্বার অভিযোগ: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওইখানে গভর্নিং বডিতে কমিটির সভাপতি বা সদস্য যারা থাকে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা প্রভাশালী ব্যক্তিবর্গ, অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে শিক্ষকরা নিজেদের নৈতিকতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হন এবং অনেক ক্ষেত্রে যেসকল শিক্ষার্থীরা খুব দুর্বল, এই নম্বরটা হয়তো ডিজার্ভ করে না ওই শিক্ষার্থীকে পূর্ণ নম্বর দিতে বাধ্য থাকিবেন। অনেক অভিভাবক ও শিক্ষকদের উপরে অন্যায় ভাবে চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের সন্তানদের কে বেশি নাম্বার দেওয়ার জন্য। এইভাবে করে কি আমরা আমাদের শিক্ষকদের জীবন আর চাকুরীকে নিরাপত্তাহীন করে ফেলতেছিনা? যে সব শ্রেণীর শিক্ষা মূল্যায়ন এর উপর ভিত্তি করে সরকারি বৃত্তি সনদ দেওয়া হয় সাপস একটা সময় ক্লাস ফাইভ ক্লাস এইটে বৃত্তি দেওয়া হইত এখনো এসএসসি বৃত্তি দেয়া হয়েছে, এসএসসি বৃত্তি দেয়া হবে, এইসব জায়গায় শিক্ষকরা কিন্তু ব্যাপক চাপ এর মুখোমুখি হবেন যদি এই বৃত্তির সিস্টেমটা চালু থাকে।
চার নাম্বার: অনেক বড় একটা অভিযোগ; বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু এন্ট্রি করতে গেলে সেই আগের পরীক্ষা পদ্ধতি আছে, আপনাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে, পড়তে হবে। এমন অবস্থা ধারণা করা হইতেছে শিক্ষার্থীরা হয়তো আলাদাভাবে কোচিং করবে এই ভর্তি পরীক্ষার জন্য। তাইলে আপনি যদি এতটা বছর ধরে এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় আপনাকে পরীক্ষা দিতে হয় তাহলে এতদিন পর্যন্ত এই শিক্ষাক্রমে থাইকা যে উদ্দেশ্যটা ছিল সেই উদ্দেশ্য আসলেই হাসিল করা হবে নাকি এ ব্যাপারে অনেকের সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
এখন কোশ্চেন করতে পারেন আমাদের দেশের জন্য এই শিক্ষাক্রম ও তা কতটুকু উপযোগী? এখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষার্থীদেরকে সারা বছর ধরে মূল্যায়ন করতে হবে এটাতে কিন্তু শিক্ষকদেরকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। একটা ক্লাসে যদি ৫০ থেকে ৬০ জন স্টুডেন্ট থাকে তাইলে এটা করা কতটা পসিবল এটা একটা কোশ্চেন এর সম্মুখীন হয়। আদর্শ একটা অনুপাত ধরা হয় শিক্ষক শিক্ষার্থীর ১:২০ অর্থাৎ একজন শিক্ষক ২০ জন শিক্ষার্থীকে দেখাশোনা করবে। বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যা ২০২১ অনুযায়ী বাংলাদেশে এই অনুপাত ১:৩২ তথা -একজন শিক্ষক এর আন্ডারে ৩২ জন স্টুডেন্ট থাকে। এইটা আরো বেশি অনেক অনেক জায়গাতেই। ধরনের এই অনুপাতে একজন শিক্ষক সারা বছর ধরে শিক্ষার্থীদের ইকোয়ালি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন এইটা নিয়ে অনেক সন্ধিহান।
তাছাড়া এই নতুন শিক্ষাক্রম ও ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে কম শতাংশ নাম্বার থাকতে সে বিজ্ঞানে। আগের বছর গুলোর সাথে যদি তুলনা করেন ১৯৯০ এ বিজ্ঞানে নম্বর ছিল ৩০%, ২০০০ সালে এটা ছিল ৩৬ শতাংশ, ২০১৭ সালের ৩১ শতাংশ আর নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞানের বিষয় সবচেয়ে কম হইছে ১০, নম্বরে শতাংশ সবচেয়ে কমে হয়েছেন ১০ পার্সেন্ট। ইতিহাসের সব সময় ৩০ শতাংশের বেশি বিজ্ঞানে নম্বর থাকত এখন কমিয়ে তা ১০ শতাংশ। এইটা নিয়ে অনেকেই কোশ্চেন করতেছেন যে এখন শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কমে যাবে কিনা। এই পৃথিবীর অনেক দেশে কিন্তু আছে যারা একাদশ শ্রেণির আগে এরকম আলাদা ভাবে বিজ্ঞান পড়ায় না। এখন পশ্চিমা বিশ্বে কালচারের সাথে বা উন্নত বিশ্বের কালচারের সাথে বাংলাদেশে কি এখনো ইকুয়াল হতে পেরেছে এটা নিয়ে প্রশ্ন করেছে অনেকেই।
তবে একটা জিনিস মানতেই হবে:
- ১. শিক্ষার্থীরা টিম ওয়ার্ক কাজ শিখবে।
- ২. বাস্তবিক শিক্ষায় এগিয়ে যাবে।
- ৩. আলাদা বাসায় গিয়ে শিক্ষা নিতে হবে না
- ৪. প্রাইভেট এর ক্যাচাল নেই
- ৫. ধীরে ধীরে এই শিক্ষাক্রমের সাথে শিক্ষার্থীরা অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
- ৬. জাপান কিন্তু প্রায় সিমিলার এই টাইপের শিক্ষা ব্যবস্থা। তারা কিন্তু পিছিয়ে নেই।
৫. শিক্ষকদের নাম্বার মানপত্রে নাম্বার দিতে যদি কোন রকম পরাধীনতার কাজ না করে তবে শিক্ষাক্রম ১০০% কার্যকর। আর যদি এক জন শিক্ষক স্বাধীনভাবে নাম্বার দিতে না পারে তবে শিক্ষা ব্যবস্থা ধসে পড়ার একটা চান্স রয়েছে।
সরকার যেহেতু এই ব্যাবস্থা চালু করতে যাচ্ছে এক জন শিক্ষকে কি ভাবে স্বাধীন প্রক্রিয়ায় কাজ করাতে হবে তা নিশ্চই তারা ভেবে রেখেছেন।
একটা জিনিস সম্পর্কে সবাইকে ধারণা থাকতে হবে শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষানীতি কিন্তু এক নয়।
নতুন আলোয় বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।
Tags
Education